Bangla News Dunia, বাপ্পাদিত্য:- দেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যম দাবি করছে, গঙ্গা তামাম দুনিয়ার একমাত্র শুদ্ধ জলের নদী। বিশেষজ্ঞরা সংবাদমাধ্যমে আরও দাবি করেন, জীবাণু ধ্বংসে গঙ্গার জল অন্য যে কোনও নদীর থেকে কমপক্ষে 50 গুন দ্রুততার সঙ্গে কাজ করে। গঙ্গার জলের নিজের কোনও জীবাণু নেই। এমন কথাও শোনা যায় নিয়ম করে।
গঙ্গার শুদ্ধতার অনেকটাই নির্ভর করে তার জলে থাকা 1,100 রকমের ব্যাকটেরিওফেজেসের উপর। সহজ কথায় এগুলি হল এমন ভাইরাস যা আদতে জীবাণুনাশক হিসেবে কাজ করে। বলিপাড়ার হিরোদের মতোই ব্যাকটেরিওফেজেসদের মারকাটারি ভূমিকার জন্য জীবাণু জলে দূষণ ছড়াতে পারে না। তবে সংবাদমাধ্যমের কাছে এমন নির্দিষ্ট সংখ্যা কী করে এলো তা বোঝা বেশ কঠিন। কারণ, আজ পর্যন্ত কোনও গবেষণায় এমন কোনও নির্দিষ্ট সংখ্যার কথা বলা হয়নি। ব্যাকটেরিওফেজেসকে একদিক থেকে গঙ্গার নিরাপত্তারক্ষী বলা যেতে পারে। তাদের জন্যই গঙ্গার জল দূষিত হয় না। আরও বলা হয়েছে, গঙ্গার জলের কিছু বিশেষ গুণ আছে। তার জন্য সে নিজেই নিজেকে পরিশুদ্ধ করে নিতে পারে। ঠিক এই কারণে অন্য সমস্ত নদীর থেকে গঙ্গা আলাদা। এই প্রশ্ন নিয়ে আরও খানিকটা গভীরে গিয়ে আলোচনা করা দরকার।
প্রথমেই মনে রাখা দরকার ব্যাকটেরিওফেজেসের উপস্থিতি শুধু গঙ্গায় আছে এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। সমস্ত নদী থেকে শুরু কররে হৃদ অথবা সাগর-সর্বত্রই জীবাণু আছে। আর ঠিক সেই সেই জায়গায় ব্যাকটেরিওফেজেসও আছে। পরিবেশ বিজ্ঞান নিয়ে 2022 সালের ডিসেম্বর মাসে একটি গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয়েছিল । সেখানে দাবি করা হয়েছিল, গঙ্গায় যে ব্যাকটেরিওফেজেস আছে তার প্রায় সমকক্ষ ব্যাকটেরিওফেজেস অন্য নদীতেও আছে । তার জেরে গঙ্গার পরিস্থিতি পৃথিবীর আরও বেশ কিছু নদীর সঙ্গে তুলনীয়।
বলা যেতে পারে ব্যাকটেরিয়া ছাড়া এই ধরনের ফেজেসের কোনও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকে না। কারণ একটি ব্যাকটেরিওফেজেস জীবাণুকে ধ্বংস করার পর সেই জীবাণুর মধ্যে ওই ব্যাকটেরিওফেজেসকে প্রতিহত করার মতো ক্ষমতা গড়ে ওঠে। তাছাড়া জীবাণুর মধ্যে থাকা কোষে হামলা করে ব্যাকটেরিওফেজেস। তা ধ্বংস হয়। সেখান থেকে ভেঙে নতুন ফেজেস তৈরি হয়। বিজ্ঞান দাবি করে, শুধু গঙ্গা নয় প্রতিটি জলাশয়েই থাকে ব্যাকটেরিওফেজেস। তবে এরপরও দেশের অন্য নদীগুলির মতো গঙ্গাও দূষিত হয়। আর সেই দূষণের মাত্রা কম নয়। এক্ষেত্রে অবশ্য ব্যাকটেরিওফেজেস কিছু করতে পারে না। তার কারণ মানুষ গঙ্গায় বিপুল পরিমাণে আবর্জনা ফেলে। এর সঙ্গে সঙ্গে আসে শিল্পাঞ্চলের আবর্জনাও।
আরও পড়ুন:- ইডলি খেলে হতে পারে ক্যান্সার! নতুন গবেষণা রিপোর্ট কি বলছে, জেনে নিন
গঙ্গার জলকে দূষণ-মুক্ত বলার মানে সেন্ট্রাল পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ডের রিপোর্টকে গ্রহণ না করা। ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনালকে সিপিসিবি জানিয়েছে, গঙ্গার জলে ফিকল ক্লোরোফর্ম পাওয়া যায়। মানুষ এবং পশুর শরীর থেকে নির্গত বিভিন্ন মাইক্রব মিশে যায় জলের সঙ্গে। আর এই গঙ্গার জলেই বহু মানুষ পূণ্যস্নান সেরেছেন মহাকুম্ভে। ওই রিপোর্ট থেকে আরও জানা গিয়েছে, ফিকল ক্লোরোফর্মের সমস্যা বাঁচিয়ে স্নানের জলের যে মান থাকা দরকার তা গঙ্গার জলে ছিল না । কয়েকটি বাছাই করা জায়গায় পরিস্থিতি আরও খারাপ ছিল বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
সিপিসিবি-র দেওয়া রিপোর্ট আরও দাবি করেছে, কুম্ভমেলা চলার সময় গঙ্গার জলে ফিকল ক্লোরোফর্মের মাত্রা অনেকটাই বেড়েছে। প্রয়াগরাজের বিভিন্ন এলাকায় ফেব্রুয়ারি মাসে কী ধরনের দূষণ হয়েছে তা সবিস্তারে উল্লেখ করা হয়েছে। শাস্ত্রী সেতুর কাছে প্রতি 100 মিলিলিটারে জলে 11,000 এমপিএন ফিকল ক্লোরোফর্ম মিলেছে। সঙ্গমে সেই মাত্রা আরও অনেক বেশি। প্রতি 100 মিলিলিটারে জলে 2,500 এমপিএন ফিকল ক্লোরোফর্ম পাওয়া গিয়েছে। সিপিসিবি বিগত কয়েকবছর ধরে গঙ্গার জলের স্বাস্থ্য কেমন রয়েছে তা নিয়ে লাগাতার নজরদারি চালাচ্ছে। পরিভাষায় একে বলা হয়, রিয়েল টাইম ওয়াটার কোয়ালিটি মনিটরিং। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, প্রতি 100 মিলিলিটারে জলে ই-কোল জীবাণুর পরিমাণ শূন্য হলে তবে সেই জলকে স্বাস্থ্য় কর বলা যায়। ত্রিবেণী সঙ্গমের জলের আরও বড় সমস্যার কারণ হল তাতে থাকা বিওডি বা বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড। জলে অক্সিজেন কী পরিমাণে মিশছে তার উপরই নির্ভর করে বিওডি। সাধারণত, এক লিটার জলের মধ্যে 3 মিলিগ্রাম অক্সিজেন মিশলে সেই জলকে স্নানের উপযুক্ত হিসেবে গ্রহণ করা হয়। সঙ্গম থেকে জানুয়ারি মাসের 16 তারিখ যে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল তাতে দেখা গিয়েছে জলে অক্সিজেন মিশে যাওয়ার পরিমাণ 5.09 মিলিগ্রাম ।
ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনাল বা পরিবেশ আদালত উত্তরপ্রদেশের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সমালোচনাতেও সরব হয়েছে। তার প্রথম কারণ এই সংস্থা আদালতে প্রয়োজনীয় সমস্ত নথি দেয়নি। আর তার জেরে দূষণের বিষয় বুঝতে আদালতেরও নানা ধরনের সমস্য়া হয়েছে। আর 12, জানুয়ারি পর্যন্ত জলের গুণমান কেমন ছিল সেই তথ্য দেওয়া হয়েছে রিপোর্টে। এর একদিন পর থেকে মেলা শুরু হয়। তাই এক্ষেত্রে এনজিটির তোপের মুখে পড়তে হয়েছে উত্তরপ্রদেশের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে। আর তাই এই তথ্যের উপর ভিত্তি করে এমন দাবি করা যায় না যে গঙ্গা ব্যাকটেরিওফেজেসের সাহায্যে নিজেই নিজের জলকে শুদ্ধ করছে । কারণ, প্রতিদিন যে বিরাট পরিমাণ জলরাশি গঙ্গায় এসে মেশে তার তুলনায় ব্যাকটেরিওফেজেসকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া প্রতিরোধের কোনও গুরুত্ব থাকে না। শুধু তাই নয়, গঙ্গা জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় সমস্যার কারণ হিসেবে উঠে আসার আশঙ্কাও থাকে ।
ব্যাকটেরিওফেজেস কোনও জীবাণুর কোষকে কীভাবে ধ্বংস করে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ । তার উপর নির্ভর করেই গঙ্গার উচ্চ অববাহিকায় জলে অক্সিজেনের পরিমাণ অনেক বেশি। আর দূষণের পরিমাণ কম। অন্যদিকে, সঙ্গমের মতো গঙ্গার নীচের দিকের অংশে দূষণের পরিমাণ অনেক বেশি। এই প্রতিবেদন লেখার সময় যোগাযোগ করা হয়েছিল কেরলের জনস্বাস্থ্য কর্মী হেমচন্দ্রন কুঞ্জকৃষ্ণনের সঙ্গে। কেরলের পাম্বা নদীর নজরদারি কাজে সরাসরি যুক্ত ছিলেন তিনি।
এই পাম্বা নদীতেও প্রচুর মানুষের জমায়েত হয় প্রতি বছর। মানে প্রতিবছর এখানেও দূষণ হয়। এর পাশেই সবরিমালা মন্দির। বছরে 40-50 মিলিয়ন ভক্ত আসেন এখানে। এই নদীর জল ব্যবহার করেন। আমার ইমেলের জবাবে তিনি লেখেন, “জনস্বাস্থ্য কর্মী হিসাবে ইদুক্কি, কোট্টায়ামের মতো জায়গায় শত শত জলাশয়ে ক্লোরিনের প্রয়োগ করেছি। এখান থেকেই আমার মনে হয়, লাখো লাখো মানুষ গঙ্গার দূষিত জলের সংস্পর্শে এসেছেন পূন্যস্নানের সময় । তাতে চামড়ার রোগের আশঙ্কা বাড়ছে। পেটের সমস্যাও বাড়ছে। এখনকার এই পরিস্থিতিতে আমাদের মিথের কোনও প্রয়োজন নেই। আমাদের জল শোধন করার উপযুক্ত পরিকাঠামো চাই। বাস্তবের পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ সেটা আমাদের বুঝতে হবে। গঙ্গা পবিত্র কিন্তু অলৌকিক নয়। গঙ্গা একটি নদীর নাম। তারও নানা ধরনের সমস্যা আছে। অন্ধ বিশ্বাস ছেড়ে বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গোটা বিষয়টি দেখতে হবে। ”
আরও পড়ুন:- সকালে ঘুম থেকে উঠেই করুন এই ৫ কাজ, পেটের মেদ ঝরবে
আরও পড়ুন:- আমেরিকাকে যুদ্ধ নিয়ে চরম হুঁশিয়ারি চিনের, জানতে বিস্তারিত পড়ুন