আরও বড় বিপর্যয়ের অপেক্ষায় কলকাতা? জানতে বিস্তারিত পড়ুন

By Bangla News Dunia Desk Bappaditya

Published on:

Bangla News Dunia, বাপ্পাদিত্য:- বিপর্যয়ের মেঘ জমছিল কিছু দিন ধরেই। দক্ষিণ কলকাতার বিদ্যাসাগর কলোনির বহুতলের ফাটল বেড়ে চলছিল। সে বাড়ি শতাব্দী-প্রাচীন নয়। বছর দশেকের পুরনো হেলে পড়া বাড়ি, তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল। তার পর থেকেই সংবাদমাধ্যমে প্রায়শই দেখা যাচ্ছে শহরের বিভিন্ন এলাকায় হেলে পড়া বাড়ির ছবি। শহরবাসীদের মনে জমতে শুরু করেছে নানা প্রশ্ন তাদের আস্তানার সুরক্ষা নিয়ে।

ফাটল কেন?

ফাটলের অন্যতম কারণ বাড়ির ভিত বসে যাওয়া। বাড়ির ভিত নির্ভরশীল তলার মাটির স্থায়িত্বের উপর। মাটির ভারবহন ক্ষমতা বেশি হলে সেই বাড়ির ভিতের নিম্নমুখী সরণ কম হয় অর্থাৎ ভিত কম পরিমাণে বসে মাটির নীচে। ভিতের মাটি নরম হলে তার ভারবহন ক্ষমতা কম হওয়ার কারণে সেই ভিত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বসতে থাকে। ভিতের এমন বসে যাওয়া বাড়তে থাকলে সেই বাড়িতে ফাটল ধরা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।

সেই সব বাড়ির কংক্রিটের বিম-কলাম–স্ল্যাব কিংবা ইটের দেওয়াল, সব কিছুতেই তৈরি হয় ফাটল। আর সেই ফাটল দ্রুত বাড়তে থাকলে ভেঙে পড়তে পারে বাড়ি, তাসের ঘরের মতো। উপরন্তু বাড়ি নির্মাণ সামগ্রীর মান এবং সঠিক নির্মাণ পদ্ধতির কারণেও বাড়ির ফাটল তৈরি হতে পারে। অবৈধ নির্মাণের ক্ষেত্রে এমন জলা কিংবা ভরাট জমি, নিম্ন মানের নির্মাণ সামগ্রী এবং ভুল নির্মাণ পদ্ধতির বিপদের সমাপতন ঘটে বলেই সেই নির্মাণ হয়ে ওঠে প্রাণঘাতী।

আরও পড়ুন:– রাজ্যে আনন্দধারা প্রকল্পে কর্মী নিয়োগ চলছে! আবেদন পদ্ধতি সহ বিস্তারিত দেখেনিন

প্রতিকারের পথ

কলকাতা শহরের অল্প উচ্চতার চার-পাঁচতলা বাড়িগুলিতে এমন ফাটল কিংবা হেলে যাওয়ার প্রবণতা উত্তরোত্তর বাড়বে বলেই আশঙ্কা। কলকাতার ভূপৃষ্ঠের নীচে থাকা পলিমাটির ভারবহন ক্ষমতা তুলনায় কম। এ ছাড়াও শহরের বহু অংশে নিচু জমি, জলা জমি, মজে যাওয়া পুকুর, খাল বুজিয়ে নির্মাণ হচ্ছে। এমন প্রেক্ষিতে অল্প গভীরে পোঁতা ভিতের উপরে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িগুলির হেলে যাওয়া কিংবা ফাটলের বিপদে পড়ার সম্ভাবনা তুলনায় বেশি।

কাজেই শহরে বহুতল নির্মাণের ক্ষেত্রে বাড়ির ভিতের নীচের মাটির চরিত্র যাচাই অতি আবশ্যিক। মাটি পরীক্ষার রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী বাড়িতে অগভীর ভিতের পরিবর্তে গভীর ভিতের (পাইল ফাউন্ডেশন) কথা ভাবা উচিত। কিন্তু গভীর ভিত নির্মাণের খরচ তুলনায় বেশি বলেই ফ্ল্যাটের দাম কমিয়ে বেশি লাভের তাগিদে গভীর ভিত অপছন্দ প্রমোটারকুলের। এমন প্রেক্ষিতে নরম মাটির ওপর বহুতল নির্মাণের ক্ষেত্রে গভীর ভিতের প্রয়োগ বাধ্যতামূলক করার কথা ভাবতে হবে। পুকুর ও জলা ভরাট রুখতে আইনের ফাঁকফোঁকর ভরাট করা এখন আরও জরুরি।

প্রয়োজন নজরদারি

মনে রাখা উচিত অবৈধ নির্মাণ সাইবার- অপরাধের মতো আড়ালে সেরে ফেলা যায় না। বেআইনি নির্মাণ হয় মাসের পর মাস, প্রকাশ্য দিবালোকে, প্রশাসনের নাকের ডগায়। ফলে শহরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে আইনি এবং বেআইনি বাড়ির তথ্যভাণ্ডার তৈরি করা জরুরি বেআইনি বিপজ্জনক বাড়িগুলি চিহ্নিত করার লক্ষ্যে। চিহ্নিত বাড়িগুলির ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমে স্বল্পকালীন ও দীর্ঘকালীন মেরামতির ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। সম্প্রতি ভেঙে-পড়া বাড়িটির হেলে পড়া ও ফাটল আটকাতে সেই বাড়ির ডেভেলপার নিয়োগ করেছিলেন হরিয়ানার এক মেরামতি সংস্থাকে।

সেই সংস্থার কেরামতিতে মেরামতির পরিবর্তে ভেঙে পড়েছে গোটা বাড়িটাই। সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী মেরামতি সংস্থার কর্মীরা ওই বাড়িটির হেলে পড়া ভিতের বিভিন্ন অংশকে হাইড্রলিক জ্যাক লাগিয়ে ঠেলে উপরে তোলার চেষ্টা করতে গিয়েই এমন বিপত্তি। এখানে প্রশ্ন ভিত মেরামতিতে নিযুক্ত সংস্থার দক্ষতা নিয়ে। শহরে এমন হেলে পড়া বাড়ি সোজা করার কাজে নিযুক্ত মেরামতি সংস্থাগুলির দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার নিরিখে পুরসভার অনুমোদন থাকা উচিত। কারণ অদক্ষ মেরামতি সংস্থাকে বাড়ির প্রমোটার নিয়োগ করার পর বিপর্যয় ঘটলে বিপদ শুধু সেই বাড়ির আবাসিকদের নয়, আশেপাশের বাড়িগুলির আবাসিকদেরও প্রাণ সংশয় ঘটতে পারে।

কুরুক্ষেত্রের প্রযুক্তি

ইতিমধ্যে স্পষ্ট যে ভেঙে পড়া বাড়িটি জলাজমির ওপরে নির্মিত হলেও মাটি পরীক্ষার কোনও প্রমাণ মেলেনি। আবার সেই বাড়ির মেরামতি সংস্থাও মাটির বৈশিষ্ট্য ও সামর্থ্য যাচাই না করেই মেরামতির কাজে হাত দিয়েছিল বলে অনুমান। গাড়ির চাকা অকেজো হয়ে গেলে যে ভাবে সেই গাড়িটির চাকার নীচে হাইড্রলিক জ্যাক লাগিয়ে অকেজো চাকা খুলে নতুন চাকা লাগিয়ে দেওয়া হয়, খানিকটা সে ভাবেই বসে যাওয়া বাড়ির ভিতকে হাইড্রলিক জ্যাক লাগিয়ে তুলে ভিতের তলার মাটিকে রাসায়নিক ইনজেকশন দিয়ে পোক্ত করা হয়। প্রযুক্তিবিজ্ঞানের পরিভাষায় এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘আন্ডার পিনিং’। কিন্তু গাড়ি মেরামতির প্রযুক্তি বাড়ি মেরামতিতে ব্যবহার করতে গেলে যে বহুমাত্রিক সতর্কতার প্রয়োজন, সম্ভবত সেই সতর্কতা উপেক্ষা করেছিল মেরামতি সংস্থা। দুর্ভাগ্য যে এমন সংস্থাগুলি গ্যারান্টি সহকারে মেরামতির বিজ্ঞাপন দিয়ে দেশজুড়ে ব্যবসা চালাচ্ছে।

বসে যাচ্ছে শহর

গত দু’দশকে জলা জমি, নিচু জমি বুজিয়ে বেআইনি নির্মাণের বহর বেড়েছে শহরজুড়ে। অথচ সেই নিচু জমি ছিল জলের পাতাল প্রবেশের পথ। নগরায়নের দাপটে বেড়েছে বাড়িঘর সেতু সড়কের মোড়কে কংক্রিটের আস্তরণ। ফলে ক্রমশ বৃষ্টির জলের পাতাল প্রবেশের পথ অবরুদ্ধ হচ্ছে। পাশাপাশি, নিচু জমিতে তৈরি হওয়া অনুমোদনহীন বেআইনি বাড়ির জলের জন্য বসছে বেআইনি গভীর নলকূপ। এমন অজস্র নলকূপ দিয়ে জল তোলার দরুণ শহরের জলস্তর নেমে চলেছে হুহু করে। ফলে ধীরে ধীরে বসে চলেছে শহরের মাটি।

বসতে থাকা সেই মাটির উপরে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়ি-ঘর-সেতুর মতো নির্মাণকাঠামোগুলিও উত্তরোত্তর বসতে শুরু করছে। শহরের ভূ-পৃষ্ঠের মাটি এই হারে বসে যেতে থাকলে এক সময় সমুদ্রের জল ঘূর্ণিঝড় কিংবা ভরা কোটালের ধাক্কা অনায়াসে ঢুকে পড়বে শহরের সীমানায়। ফলে এখন থেকেই ধারণক্ষমতার ভিত্তিতে শহরে নতুন বাড়ির নির্মাণের অনুমোদন দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরি। কলকাতা শহরের পুরনো নিচু বাড়ি ভেঙে অচিরেই অনেক মানুষের আস্তানা নিশ্চিত করতে শহর বাড়বে উচ্চতায়, তৈরি হবে বহুতলের সারি। এমন নরম মাটির শহরে বেআইনি নির্মাণের দাপটেই শুধু নয়, তথাকথিত ‘আইনসিদ্ধ’ বাড়ির বেলাগাম বৃদ্ধিতেও উত্তরোত্তর বিপন্ন হতে চলেছে শহর কলকাতার বাস্তুতন্ত্র।

ভূমিকম্প হলে?

ভূমিকম্পের ধাক্কা ছাড়াই বহুতল ভেঙে পড়ছে নির্মাণের গলদের কারণে। কিন্তু এমন গলদ-ভরা কাতারে কাতারে নির্মাণ যদি গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণে, সেগুলি ভূমিকম্পের সময়ে হয়ে উঠতে পারে বিপর্যয়ের এপিসেন্টার। সাম্প্রতিক বেশ কিছু সমীক্ষায় কলকাতা শহরের বিভিন্ন অঞ্চল ভূমিকম্পের নিরিখে যথেষ্ট ঝুঁকিপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। শহর-লাগোয়া নিউটাউন, রাজারহাট, মহিষবাথান থেকে শুরু করে কসবা, যাদবপুর, বেহালা, পার্ক স্ট্রিট, শোভাবাজারের মতো অঞ্চল রয়েছে সেই তালিকায়।

অথচ দুশ্চিন্তার বিষয় যে, এমন অনেক অঞ্চল জুড়েই গত দু’দশকে বহুতল নির্মাণের হার সর্বাধিক। বেড়ে চলা শহরে বাড়ছে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়ির সংখ্যা। কিন্তু এমন একাধিক বাড়ির ভারবাহী ভিত গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকলে একটা বাড়ির ভার অন্য বাড়ির ভিতের ঘাড়ে চেপে বসতে পারে। খানিকটা উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপার মতো। অন্য দিকে ভূমিকম্পের সময়ে ভিতের নরম মাটির ভারবহন ক্ষমতা দ্রুত কমে যায়। এবং এমন ভিতের উপরে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়ির ভারসাম্যের বিপদ ভূমিকম্পের সময় আরও বেড়ে ওঠে। স্বাভাবিক সময়ে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা দু’টি বহুতল আলো বাতাস চলাচল কিংবা দমকলের গাড়ি ঢোকার নিরিখে ঝুঁকিপ্রবণ। কিন্তু এমন ঝুঁকি ভূমিকম্পের সময়ে প্রবলতর হয়ে ওঠে বাড়ি ভেঙে পড়ার আশঙ্কায়।

কাজেই শহরজুড়ে বহুমাত্রিক বিপর্যয় মোকাবিলার স্বার্থেই এমন বহুতল আবাসন নির্মাণে রাশ টানা আশু প্রয়োজন। শহরের কলোনি এলাকায় নির্মাণের ক্ষেত্রে পুর আইনের কিছু ছাড় থাকলেও বাড়ির কাঠামোগত স্থায়িত্ব কিংবা মাটির ধারণক্ষমতা যাচাই ছাড়া বহুতল নির্মাণের উপর নিয়ন্ত্রণ সেখানেও জরুরি। মনে রাখতে হবে যে পুর-কর দেওয়া শহরের নাগরিকের বাসস্থানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায় শহরের পুর-প্রশাসনেরই। পুর-বিধি অনুযায়ী কমপ্লিশন সার্টিফিকেট ইস্যু করার মধ্যেই নিহিত থাকে পুর-বিধি অনুযায়ী বহুতল নির্মাণ সুসম্পন্ন হওয়ার প্রমাণ। কাজেই বহুতল নির্মাণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই বাসস্থান কেনাবেচা জরুরী। এ ক্ষেত্রে পৌরসভার পাশাপাশি নাগরিক সমাজকে সচেতন হতে হবে। সস্তায় বাড়ি কিনতে গিয়ে বেআইনি বাড়ি কিনলে যে ধনে প্রাণে মারা যাওয়ার বিপদ, সেই শিক্ষা দিচ্ছে এমন বিপর্যয়।

লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণবিদ্যার শিক্ষক

Bangla News Dunia Desk Bappaditya

মন্তব্য করুন