আইএনএস বিক্রান্ত, এই নামটি ভারতীয় নৌবাহিনীর শক্তি, শৌর্য এবং আত্মনির্ভরতার প্রতীক। দুটি ভিন্ন সময়ে, দুটি ভিন্ন যুদ্ধজাহাজ এই নামে ভারতের সামুদ্রিক সীমান্তে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করেছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। বিশেষত, ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের প্রেক্ষাপটে আইএনএস বিক্রান্তের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্লগ পোস্টে আমরা অতীতের আইএনএস বিক্রান্ত (আর১১) এবং বর্তমানের আধুনিক আইএনএস বিক্রান্ত (আইএসি-১) – উভয়ের ক্ষমতা এবং ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আবহে তাদের প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরব।
অতীতের গৌরব: আইএনএস বিক্রান্ত (আর১১) ও ১৯৭১-এর যুদ্ধ
১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে, তৎকালীন আইএনএস বিক্রান্ত (আর১১) এক কিংবদন্তীর ভূমিকা পালন করেছিল। ব্রিটেনের কাছ থেকে সংগৃহীত এই বিমানবাহী রণতরীটি ছিল ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রথম এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার
আরও পড়ুন : ভারত-পাকিস্তান সংঘাত আরও বাড়লে কী করবে আমেরিকা ? জানতে বিস্তারিত পড়ুন
- পূর্ব পাকিস্তানে নৌ অবরোধ: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আইএনএস বিক্রান্ত বঙ্গোপসাগরে পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) বিরুদ্ধে কার্যকর নৌ অবরোধ তৈরি করে। এর ফলে পাকিস্তানি নৌবাহিনীর সরবরাহ এবং পালানোর পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।
- বিধ্বংসী বিমান হামলা: বিক্রান্ত থেকে উড়ে যাওয়া সি হক এবং আলিজে যুদ্ধবিমানগুলি চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খুলনা, মংলা বন্দর এবং পাকিস্তানি সামরিক ঘাঁটিগুলিতে সফলভাবে আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে বহু পাকিস্তানি জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়া হয় বা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তাদের সামরিক পরিকাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে।
- পিএনএস গাজীর সলিলসমাধি: যুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল পাকিস্তানি ডুবোজাহাজ পিএনএস গাজীর রহস্যজনকভাবে ডুবে যাওয়া। এই ডুবোজাহাজটিকে পাঠানো হয়েছিল আইএনএস বিক্রান্তকে ধ্বংস করার জন্য। ভারতীয় নৌবাহিনীর কৌশলের কাছে পরাস্ত হয়ে বিশাখাপত্তনমের কাছে এটি ধ্বংস হয়, যা যুদ্ধের গতিপথ ভারতের অনুকূলে আনতে সহায়ক হয়েছিল। যদিও বিক্রান্ত তখন আন্দামানের কাছে সুরক্ষিত অবস্থানে ছিল।
- যুদ্ধের ফলাফলে প্রভাব: আইএনএস বিক্রান্তের এই অনবদ্য ভূমিকা সমুদ্রপথে ভারতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে এবং দ্রুত যুদ্ধ জয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এর নাবিক ও পাইলটরা তাদের বীরত্বের জন্য একাধিক সাহসিকতার পুরস্কারে ভূষিত হন।
তবে, ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় আইএনএস বিক্রান্ত মেরামতির জন্য ড্রাই ডকে থাকায় অংশগ্রহণ করতে পারেনি।
নয়া শক্তি, নয়া বিক্রান্ত (আইএসি-১)
প্রায় পাঁচ দশক পর, ২ সেপ্টেম্বর ২০২২-এ ভারতীয় নৌবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সম্পূর্ণ স্বদেশী প্রযুক্তিতে নির্মিত নতুন আইএনএস বিক্রান্ত (আইএসি-১)। এটি ভারতের প্রথম নিজস্ব বিমানবাহী রণতরী নির্মাণ প্রকল্পের এক বিশাল সাফল্য এবং “আত্মনির্ভর ভারত”-এর এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
- বিশাল ক্ষমতা ও আধুনিক প্রযুক্তি:
- ওজন ও আয়তন: প্রায় ৪৫,০০০ টন ওজনের এই রণতরীটি ২৬২ মিটার লম্বা এবং ৬২ মিটার চওড়া।
- বিমান বহন ক্ষমতা: এটি মিগ-২৯কে যুদ্ধবিমান, কামোভ কেএ-৩১ আর্লি ওয়ার্নিং হেলিকপ্টার, এমএইচ-৬০আর মাল্টি-রোল হেলিকপ্টার এবং স্বদেশী হালকা হেলিকপ্টার (যেমন ধ্রুব) সহ ৩০ থেকে ৪০টি বিমান বহন করতে সক্ষম।
- গতি ও পাল্লা: চারটি শক্তিশালী জেনারেল ইলেকট্রিক গ্যাস টারবাইনের সাহায্যে এটি ঘণ্টায় ২৮ নট (প্রায় ৫২ কিমি) গতিতে চলতে পারে এবং একনাগাড়ে প্রায় ৭,৫০০ থেকে ৮,৬০০ নটিক্যাল মাইল (প্রায় ১৩,৯০০ থেকে ১৫,৯০০ কিমি) অতিক্রম করতে পারে।
- অস্ত্রশস্ত্র: এতে রয়েছে ইসরায়েলি বারাক-৮ ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য মিসাইল (৬৪টি সেল), ব্রহ্মোস ক্রুজ মিসাইল, একাধিক একে-৬৩০ ক্লোজ-ইন ওয়েপন সিস্টেম (CIWS) এবং অটো মেলারা ৭৬ মিমি নেভাল গান।
- রাডার ও সেন্সর: এতে রয়েছে অত্যাধুনিক এলটা ইএল/এম-২২৪৮ এমএফ-স্টার অ্যাক্টিভ ইলেকট্রনিক্যালি স্ক্যানড অ্যারে (AESA) রাডার এবং সেলেক্স আরএএন-৪০এল দূরপাল্লার নজরদারি রাডার, যা বহু লক্ষ্যবস্তুকে একসঙ্গে ট্র্যাক করতে পারে।
- অন্যান্য সুবিধা: ১৪টি ডেক বিশিষ্ট এই রণতরীতে প্রায় ১,৬০০-১,৭০০ নৌসেনা ও বায়ুসেনার সদস্য থাকতে পারেন। এতে অত্যাধুনিক অপারেশন থিয়েটার সহ একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতালও রয়েছে।