পদধূলি পড়েছিল মহাপ্রভুর ! ৫০০ বছর ধরে চলছে কুলীনগ্রামের ঐতিহাসিক রথযাত্রা

By Bangla News Dunia Dinesh

Published on:

Bangla News Dunia,  Pallab : শ্রী চৈতন্যদেবের পদধূলি ধন্য বাংলার এক প্রাচীন জনপদ কুলীন গ্রাম। পুরীর জগন্নাথদেবের রথ যাত্রার সঙ্গে আজও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে এই কুলীন গ্রামের নাম। ৫০০ বছরেরও বেশী সময় ধরে নিষ্ঠা সহকারে কুলীনগ্রামেও রথযাত্রা উৎসব

পালিত হয়ে আসছে। চৈতন্যদেবের আদেশ মেনে পুরীর জগন্নাথের রথের জন্য কুলীনগ্রাম থেকেই একদা পাঠানো হত ‘রেশমের পট্টডোরী’। রথের অনেক আগেই সেই পট্টডোরী পুরীতে পৌছে দেওয়া হত। এই প্রথা এখন থমকে রয়েছে ঠিকই। তবে মাহাত্ম্য গুনের বিচারে কুলীন গ্রামের রথ আর পুরীর রথ একই বলে বিশ্বাস করেন ভক্তরা।

আরও পড়ুন : ঘন ঘন বাজ পড়ার সময় নিজেকে কীভাবে বাঁচাবেন? জানলে বিপদে কাজে আসবে

কুলীনগ্রাম, পূর্ব বর্ধমান জেলার জামালপুর ব্লকের আবুজহাটী ২ পঞ্চায়েত এলাকার ঐতিহ্যশালী একটি গ্রাম। ভারতের বিখ্যাত পুরীর রথের সঙ্গে বহুকাল আগে থেকে ভক্তিভাবের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এই কুলীনগ্রামের রথের। কথিত আছে, কুলীন গ্রামের বসু পরিবারই কুলীনগ্রামে রথ যাত্রা উৎসবের সূচনা করেছিলেন। পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে কুলীন গ্রামে জন্মগ্রহন করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের অমূল্য গ্রন্থ ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্যের রচয়িতা মালাধর বসু। এই মালাধর বসুর পৌত্র লক্ষ্মীকান্ত বসু সত্যরাজ খান নামে ভূষিত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন শ্রীচৈতন্য দেবের অন্যতম ভক্ত ও পার্ষদ। পুরীর জগন্নাথ দেবের রথের জন্য কুলীনগ্রাম থেকে সত্যরাজ খানকে পট্টডোরী পাঠানোর আদেশ করেছিলেন স্বয়ং শ্রীচৈতন্যদেব। ভক্ত সত্যরাজ খান সেই আদেশ মাথাপেতে পালন করেছিলেন বলে এলাকায় কথিত আছে।

কুলীনগ্রাম বাসীর কথা অনুযায়ী, আগে প্রতি বছর রথের নির্দিষ্ট দিনের অনেকটা আগেই এখানকার বসুপরিবার থেকে পুরীতে পট্টডোরী পৌঁছে দেওয়া হত। সেই প্রথা মেনে বেশ কয়েকশো বছর যাবৎ রথের অনেক আগেই কুলীনগ্রাম থেকে পট্টডোরী পৌছে যেত পুরীতে। মাঝে কয়েকটা বছর পট্টডোরী খামে ভরে ডাকযোগে পুরীতে পাঠানো হচ্ছিল। কয়েক বছর হল সেই প্রথা বন্ধ হয়েছে। তবুও রথের দিন গোটা দেশের ভক্তদের ভিড়ে জমজমাট থাকে ইতিহাস প্রসিদ্ধ কুলীন গ্রামের রথযাত্রা উৎসব প্রাঙ্গন।

বৈষ্ণবতীর্থ কুলীনগ্রামের মধ্যস্থলে রয়েছে জগন্নাথ দেবের মন্দির। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখানে নিমকাঠের তৈরি জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার বিগ্রহের পুজোপাঠ হয়ে আসছে। রথ যাত্রা উৎসবের আগে থেকে এই বিগ্রহ নতুন রঙে সাজানো হয়। যে সুসজ্জিত রথে এই তিন দেবতাকে রথের দিন বসানো হয় সেটি সূচনা কালের না হলেও রথটি বহুদিনের পুরানো। প্রায় ৩০ ফুট উচ্চ রথটি শাল, সেগুন ও নিম কাঠ দিয়ে তৈরি বলে সেবাইতরা জানিয়েছেন।

ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে জানা গিয়েছে, “আনুমানিক ৫০০ বছররেও বেশী সময় আগে মালাধর বসুর পৌত্র লক্ষ্মীকান্ত বসু কুলীনগ্রামে জগন্নাথদেবের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার বহুকাল পরে কুলীনগ্রামে শুরু হয়েছিল রথযাত্রা উৎসব পালন। এমনটা হওয়ার কারণ কি ছিল তা অবশ্য কুলীন গ্রামের এখনকার রথযাত্রার উৎসব আয়োজকদের কেউই জানাতে পারেননি।

রথযাত্রা উপলক্ষে প্রতিবছর শ্রীচৈতন্যদেবের পদধূলী ধন্য কুলীনগ্রামে ভক্তদের ঢল নামে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তরা রথের দিন  কুলীনগ্রামে জড়ো হন। রথ উপলক্ষে কুলীনগ্রাম জুড়ে বিশাল মেলাও বসে। পুজারী শচীনন্দন মুখোপাধ্যায় জানান, “রথের দিন সকাল থেকে সাবেকি রীতি মেনে কুলীনগ্রামের জগন্নাথ মন্দিরে বিশেষ পুজোপাঠ হবে। এখানকার পুজোয় অন্যান্য ফল যাই থাক কাঁঠাল চাই। এছাড়াও প্রভু জগন্নাথ দেবের জন্য খিচুড়ি ভোগ, বলরাম দেবের জন্য অন্নভোগ ও সুভদ্রাদেবীর জন্য পায়েস ভোগ রান্না করা হয়। এইসব কিছুই দেবতাকে নিবেদন করে পুজোপাঠ শুরু হয়।”

পুজারী আরও জানান, “পুজোপাঠ শেষে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার বিগ্রহ মন্দির থেকে বাইরে বার করা হয়। রীতি মেনে প্রথমে রথের চার পাশে বিগ্রহগুলি সাতবার ঘোরানো হয়। এর পর রথের সবথেকে উঁচু ধাপে বসানো হয় বিগ্রহ গুলিকে। রথে বিগ্রহগুলি বসানোর পর ফের একপ্রস্থ পুজোপাঠ হয়। তারপর রথে ওঠেন প্রধান পুজারি। রথ টানার জন্য দুটি দড়ি রথে বাঁধা হয়। রথের দিন বিকালে রথ টেনে নিয়ে যাওয়া হয় কুলীন গ্রামের রথ তলায়। সেখানে থাকা রঘুনাথ জিউ এর মন্দিরটি জগন্নাথ দেবের মাসির বাড়ি বলে পরিচিত। প্রধান পুরোহিত এবং সহযোগী পুরোহীত তিন দেবতার বিগ্রহ রথ থেকো নামিয়ে রঘুনাথ জিউয়ের মন্দিরে রেখে আসেন। উল্টোরথের দিন ঠিক একই ভাবে তিন দেবতার বিগ্রহ ফের জগন্নাথ মন্দিরে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়।”

শ্রীচৈতন্যদেবের স্মৃতিকে আঁকড়ে বৈষ্ণব তীর্থ কুলীন গ্রামে হওয়া রথযাত্রা উৎসবের খ্যাতি এখন দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশবাসীর হৃদয়েও বৈষ্ণব তীর্থ কুলীনগ্রাম এক পবিত্র তীর্থভুমি হিসাবে স্থান করে নিয়েছে। রাজ্য সরকার কুলীন গ্রামকে বাংলার অন্যতম পর্যটন স্থান হিসাবে স্বীকৃতিও দিয়েছে। সেই স্বীকৃতি কুলীন গ্রামকে আরও বিখ্যাত করে তুলেছে।

Bangla News Dunia Dinesh

মন্তব্য করুন