Bangla News Dunia , অমিত : আরজি কর কাণ্ডের পরে টানা ৪২ দিন ‘সফল’ আন্দোলন করেছেন জুনিয়ার ডাক্তাররা। প্রথমে আরজি করের সামনে। পরে স্বাস্থ্য ভবনের চৌহদ্দির ঠিক বাইরে। এর পরেই তাঁদের আন্দোলনের নেতৃত্বের মধ্যে কিছুটা ছন্নছাড়া ভাব যে এসেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। পরবর্তী আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি নিয়ে তাই কেমন যেন দ্বিধাগ্রস্ত মনে হচ্ছে ওই তরুণ তুর্কিদের।
আর এসব দেখে তাঁদের আন্দোলনে শামিল হওয়া সাধারণ মানুষেরা, যাঁরা পিছনে না থাকলে কখনোই ওই আন্দোলন গণ আন্দোলনের চেহারা নিত না, কিছুটা হতোদ্যম। আর এই পরিস্থিতিতে নানা ‘খবর’ বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ বলছেন, রাজ্য সরকারের সঙ্গে ‘সেটিং’ হয়ে গিয়েছে আন্দোলনকারীদের। আবার কেউ বলছেন, জুনিয়ার ডাক্তারদের মধ্যে রাজনৈতিক মতাদর্শের সংঘাত হওয়ায় সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হচ্ছে। সর্বত্র দ্বিধা।
ডাক্তারির ছাত্রদের মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ যে রয়েছেন, আন্দোলনের সময়েই তা তাঁরা প্রকাশ্যে জানিয়েওছিলেন। জুনিয়ার ডাক্তারেরা এসব ‘জল্পনা’ ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেও, তাঁদের আন্দোলনের ভবিষ্যৎ পথ নিয়ে তাঁরা কিছুটা যে আতান্তরে, তা যত দিন যাচ্ছে একটু একটু করে প্রতীয়মান।
তবে সাগর দত্ত মেডিকেল কলেজে পরপর দুই দিন বহিরাগতদের হামলার ঘটনায় সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব কেটে গেল। জুনিয়ার ডাক্তারদের আন্দোলনের নতুন মঞ্চ এবার সাগর দত্ত। পরপর আন্দোলনের ঘোষণাও করলেন ডাক্তাররা। রবিবার ফের পাড়ায় পাড়ায় সভা হল। এরপর রয়েছে মঙ্গলবারের মহিলা সমাবেশ। মুখ্যমন্ত্রীর পুজো উদ্বোধনের পাশাপাশি নতুন এক উৎসবে মাতবে কলকাতা। আরজি কর মেডিকেল কলেজের মতো ঘটনা যাতে আর না ঘটে তার শপথ নেওয়ার উৎসব।
আরো পড়ুন:- ৯ বছর পর উচ্চ প্রাথমিকে ১৪০৫২ শিক্ষক নিয়োগ! DA, HRA, বেতন সহ মাসে কত পাবেন তাঁরা?
আর আন্দোলনে শামিল হওয়া সাধারণ মানুষেরা অবশ্য চাইছেন, গণ আন্দোলন যাতে কোনওভাবেই এক বা একাধিক রাজনৈতিক দলের কুক্ষিগত হয়ে না যায়। সেটা ঘটলে আন্দোলন তবে লক্ষ্যহীন, শৃঙ্খলাহীন হয়ে পড়বে। চিকিৎসক-প্রশাসকেরা কোনও রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকলে যে কী হয়, রাজ্যের বর্তমান স্বাস্থ্য দপ্তরই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। সরকারি চিকিৎসকদের কেউ কেউ প্রকাশ্যেই আরজি করের ঘটনার পিছনে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের কারও অবাধ নীতিহীনতাকে দায়ী করেছেন।
তাঁরা বলছেন, মূলত তিনটি বিষয়ের উপরে দাঁড়িয়ে রাজ্যে চিকিৎসক তৈরি এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার মূল পরিকাঠামোটি। (ক) স্বাস্থ্য ভবনে অর্থাৎ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরিচালন কেন্দ্র। (খ) রাজ্য স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং (গ) রাজ্য মেডিকেল কাউন্সিল।
এরাই স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর হর্তাকর্তা-বিধাতা। কারণ তাদের মাধ্যমেই নির্ভর করে চিকিৎসা পরিষেবা, চিকিৎসকের মান, চিকিৎসা পরিষেবা ও চিকিৎসকদের দায়বদ্ধতার উপরে নজরদারি। সরকারি হাসপাতালের এক ক্যানসার বিশেষজ্ঞের মন্তব্য, ঘুণ ধরে গিয়েছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নামের পরিষেবার ভরকেন্দ্রে।
কিন্তু তিনটি খুঁটি একসঙ্গে বিকল হল কীভাবে?
চিকিৎসকদের বড় অংশের বিশ্লেষণ, তিন খুঁটি জোট বেঁধেছে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে। উদ্দেশ্য বালি চুরি, গোরু চুরির মতো এখানেও মোটা টাকা উপার্জন। এর জন্য প্রয়োজন ছিল ক্ষমতার আস্ফালন। আর ক্ষমতা মানেই রাজনৈতিক ক্ষমতা। এবং সেটা একমাত্র দিতে পারে শাসকদল। বস্তুতপক্ষে, স্বাস্থ্য ভবন, রাজ্য মেডিকেল কাউন্সিল ও স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় একই সুতোয় নিজেদের গেঁথেছে। সুতো কার হাতে তা নিয়ে মানুষের মনে সুনির্দিষ্ট ধারণা রয়েছে।
এই সব রাজনৈতিক ধ্বজাধারীরা কিন্তু কেউ আদর্শগত রাজনীতি করেন না। আদর্শবাদী রাজনীতি কথাটা আর কয়েকবছর পরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হবে বিভিন্ন লেখায়, বক্তৃতায়। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি কিংবা কাউকে খুশি করার জন্য, কারও নেকনজরে থাকার জন্য এই রাজনীতিটাই এখন দস্তুর। স্বাস্থ্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ার মূলে এই ‘ধান্দাবাজ’ রাজনীতি। শুধু এই রাজ্য বললে ভুল হবে, এটাই এই দেশের সামগ্রিক চিত্র।
যাঁরা ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে আসা, তাঁদের অধিকাংশই এই রাজনীতির সঙ্গে নিজেদের খাপ খাওয়াতে না পেরে রাজনীতিকে ঠাঁই দিয়েছেন নিজের মনের ভিতরে। কিন্তু যেসব ছাত্র নেতা ছাত্র ভর্তি, পরীক্ষায় পাশ করানো এসবের জন্য অর্থের লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন, পরবর্তীকালে কর্মজীবনেও তাঁরা সেই ‘রাজনীতি’র খোঁজ করেছেন। স্বাস্থ্য ভবন, মেডিকেল কাউন্সিলের মধ্যে এমন কাউকে কাউকে খুঁজে পাওয়া যেতেই পারে। কলেজ জীবনের ডানপন্থী/বামপন্থী/অতি বামপন্থী রাজনীতির পথ পরিবর্তনেও কোনও অন্যায় দেখেন না তাঁরা।
কলেজ জীবনের রাজনীতি আর পেশাগত জীবনের রাজনীতি দুই বিপরীত মেরুর। কলেজের রাজনীতি অনেক ক্ষেত্রেই ‘হুজুগ’-এর রাজনীতি। কোথাও বাধ্য হয়েই ছাত্র সংগঠনে নাম লেখানো। কলেজের অনেক আদর্শবান ছাত্র নেতা পরবর্তীকালে পেশাগত বাধ্যবাধকতায় তথাকথিত পুঁজিবাদের দাসত্ব মেনে নিয়েছেন, এমন বহু উদাহরণ রয়েছে। তাঁরা কিন্তু শেষপর্যন্ত কর্পোরেটকেই বেছে নিয়েছেন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে দাপিয়ে ছাত্র রাজনীতি করা ছাত্রছাত্রীদের কতজন সফল রাজনৈতিক নেতা হতে পেরেছেন তা হাতে গুনে বলা যায়। চিকিৎসক ছাত্র নেতারাও তার ব্যতিক্রম নন।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়কে চিকিৎসক হিসেবে মানুষ বলতেন ধন্বন্তরি। আবার রাজনৈতিক নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বিধানবাবুকে সমীহ করে চলতেন। বিধানবাবু রাজনীতির সঙ্গে ডাক্তারি পেশাকে কখনও গুলিয়ে ফেলেননি।
আরজি কর কাণ্ডের পরে যেসব শিক্ষক নেতার নাম উঠে আসছে, তাঁদের মধ্যে দু’-একজন ছাত্র নেতা হিসেবেও ‘জনপ্রিয়’ ছিলেন। সরকারি পরিষেবায় যোগ না দিয়েও, হয় মেডিকেল কাউন্সিল কিংবা ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে নিজের ক্ষমতার আস্ফালন দেখিয়েছেন এই সেদিনও। আরজি করের নারকীয় ঘটনার আগে পর্যন্ত।
১৯৯৪ সালের জুনিয়ার ডাক্তারদের আন্দোলনটিকে খুব কাছ থেকে দেখেছি সাংবাদিক হিসেেব। ইডেন হসপিটাল রোডে জুনিয়ার ডাক্তারদের হস্টেলে আমার অনেকটা সময়ই কাটত। মেধাবী একদল ছেলেকে একেবারে কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। ওই আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের সবাই পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক হয়েছেন। তবে এঁদের মধ্যে ব্যতিক্রমী একজনের কথা আমার এখনও মনে আছে।
সে সময় অন্য সব কলেজে এসএফআইয়ের একচ্ছত্র আধিপত্য থাকলেও, কলকাতার মেডিকেল কলেজগুলিতে, প্রেসিডেন্সি কলেজে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অতি বাম সমর্থকরাই পাল্লায় ভারী ছিলেন। ওইসব ছাত্র নেতাদের বেশিরভাগই ‘শখের’ রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই পরবর্তীকালে রাজনীতিতে সহজেই হারিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু হারিয়ে যাননি গিরীশ বেরা। যদি স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা না করে, ১৯৯৪ সালের জুনিয়ার ডাক্তার আন্দোলনের অন্যতম মুখ ছিলেন ওই গিরীশ।
শুনেছিলাম উচ্চ মেধার গিরীশ ছত্তিশগড়ের আদিবাসী প্রধান এলাকায় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পরিচালিত হাসপাতালে যোগ দিয়েছেন। সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন তাঁর সিনিয়ার-জুনিয়ার বেশ কয়েকজন চিকিৎসক। শোষণমুক্ত সমাজ গিরীশরা হয়তো গড়তে পারেননি, কিন্তু সেই সমাজ গড়ার আন্দোলনে সেবা দিয়ে অংশগ্রহণ করেছেন।
ছাত্র নেতা গিরীশ এক ধরনের। আবার আরজি কর কাণ্ডের পর প্রকাশ্যে আসা সৈকত, বিরূপাক্ষরা এক ধরনের ছাত্র নেতা। গিরীশদের আন্দোলনে ১৯৯৪ সালে বেশ কিছুদিন রাজ্যের সরকারি হাসপাতালে কাজকর্ম বিপর্যস্ত হয়েছিল। কিন্তু কোনও ডাক্তারি ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি। ফেল করা ছাত্র গুচ্ছ গুচ্ছ নম্বর পাননি। শতকরা ৮০ নম্বর পাওয়ার যোগ্য ছাত্র শতকরা ৩০ পেয়ে চোখের জল ফেলেননি। ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দিতে চেয়ে অবসাদে চলে যাননি। যদি ছাত্র রাজনীতির পরিণতি এটাই হয়, তাহলে সেই ছাত্র রাজনীতির কী প্রয়োজন তা নিয়ে কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে।
বামফ্রন্টের আমলে এক ছাত্র পরিষদের নেতা আমাদের কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে অবাধ বিচরণের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তিনি ডাক্তার হিসেবে কতটা সফল তা জানা নেই, তবে রাজ্যে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরে মেডিকেল কাউন্সিল, মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের তিনিই ছিলেন হর্তাকর্তা। কলকাতা মেডিকেল কলেজ ছিল ওঁর জমিদারি। বিধায়ক হয়েছেন দু’বার। একবার আধামন্ত্রীও ছিলেন। তবে রোগীর কাছে ‘ভগবান’ হয়ে ওঠার সুযোগ নিতে ব্যর্থ। সরকারি মেডিকেল কলেজে একজনকে ডাক্তার তৈরি করতে সরকারের বহু লক্ষ টাকা খরচ হয়। সেখানে ডাক্তার না হয়ে ‘দাদা’ হয়ে ওঠাটা খুবই বেদনাদায়ক।
আরজি কর কাণ্ডের পরে জুনিয়ার ডাক্তারদের আন্দোলন রাজনৈতিক মদতপুষ্ট বলে রাজ্যের শাসকদলের অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। এ ব্যাপারে ছাত্র নেতারা পরিষ্কার জানিয়েছিলেন, ‘আমাদের রাজনৈতিক আদর্শ আলাদা হতে পারে। কিন্তু এখন আমরা সবাই এক।’ সিনিয়ার ডাক্তারদের মধ্যেও দুই ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ একই সুরে কথা বলেছেন।
এ ব্যাপারে রাজ্যের এক প্রবীণ চিকিৎসকের সতর্কবার্তা : ‘ডাক্তার গলায় স্টেথো ঝুলিয়ে ঝান্ডা ধরলে এবং রাজ্য সরকার তাকে সমর্থন করলে আবার আরজি করের মতো ঘটনা ঘটে যেতে পারে।’ তিনি যা বলছিলেন, সেটাই সত্যি। রাজ্য স্বাস্থ্য প্রশাসন পুরোপুরি ভেঙে পড়ার আগে এখনই আরজি করের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ডাক্তারি পঠনপাঠন ও পরিষেবায় আমূল পরিবর্তন আনুক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।
#End